নতুন বাংলাদেশ, তথাকথিত বিজয় ও বাস্তবতা

গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলন সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ের পর, স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে দেশে রচিত হলো নতুন বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ ২.০ এর ভিত্তি। 

ছবি: স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের দাবীতে ছাত্র জনতার ঢল।


স্বৈরাচারী হাসিনা আদতে পালিয়ে গেলেও দেশে বপন করে গেছে অস্থিরতার বীজ। আন্দোলন-পালটা আন্দোলন, জোরপূর্বক পদত্যাগ, আনসার লীগের হট্টগোল, লুটপাট, ডাকাতি, গণপিটুনি ও লাইলাতুল গুজবের মতো ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে দেশের মানুষ। এসব দেখে অনেকেই বলছে, এমন স্বাধীনতাই কি আমরা চেয়েছিলাম?


আসলে বাস্তবতা হচ্ছে স্বৈরাচার পতন কিংবা গনঅভ্যুত্থানের পর এসব ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু কথা হচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব দমনে কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছে? 


বাংলাদেশকে একরকম বলা যায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আতুড়ঘর। দেশটির স্বাধীনতার ৫৪ বছরে পা দিলেও এখনও পর্যন্ত গণতান্ত্রিক শাসনের মুখ খুব একটা দেখতে পারেনি। মূলত গনতান্ত্রিক সরকারের দাবিতে ৭১ এ দেশ স্বাধীনের পর বাকশাল, জিয়া সরকারের আমল, মার্শাল ল, স্বৈরাচারী এরশাদের আমল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিহীন খালেদার নির্বাচন জয় পরে পদত্যাগ, রাতের ভোটের রাণী হাসিনার শাসনামলের মতো কালো অধ্যায় বাদ দিলে দেশটিতে হাতেগোনা কয়েকবারই মাত্র সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। বাকশালি মুজিবের পতনের পরও দেশ অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে চালিত হলে দেশের স্বার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশের ক্ষমতা হাতে নেন মেজর জিয়া। এবং যে উদ্দেশ্যে তিনি ক্ষমতায় আসেন তিনি সেখানে সফলই বলা যায়।

ছবি: হাসিনার দেশত্যাগের মূহুর্ত


এখন আসি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বেলায়, আজ প্রায় একমাস হতে চললো এ সরকারের। দেশের স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং আইনের শাসনের লক্ষ্যে তড়িঘড়ি করে এ সরকার গঠিত হলেও, দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা আমার চোখে একরকম ব্যার্থই বলা যায়। যদি আমি সরকারের ব্যর্থতার লিস্ট শুরু করি তাহলে আজকের লেখা শেষ করতে পারবোনা, তবুও আমার যুক্তিকে শক্তিশালী করতে কয়েকটি বিষয় যেগুলো না বললেই নয় সেগুলো বলি। প্রথমেই আসি থানা ও সরকারি কর্মকর্তা যারা সরকার পতনের পর দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছে কিংবা ব্যার্থ হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা অথবা অন্তত তালিকা হয়েছে কিনা? সংখ্যালঘুদের উপর হামলার নেপথ্যে কারা ছিলো তাদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে কিনা? অথবা হামলার গুজব ছড়ানোর কাজে নিয়োজিতদের? হাসিনা এবং তার দোসরদের কেন সেফ এক্সিট দেয়া হয়েছিলো সে ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় ভাবে কোন প্রশ্ন তোলা হয়েছে কিনা? এবং হঠাৎ করেই কেন ১৭ কোটি মানুষের ৩৪ কোটি দাবীদাওয়া হবে সে ব্যাপারে কোন তদন্ত কমিটি? আমি জানি সবগুলোরই উত্তর এক কথায় দেয়া যাবে, "না"।


অপরদিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা তাদের ব্যানারে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের আদলে নতুন ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টায়। প্রাথমিকভাবে এমন কর্মকান্ড আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিতে আমরা দেশের জনগন সমর্থন করলেও দীর্ঘমেয়াদে তা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বৈ আর কিছুই বলা যাবে না। তদুপরি এসব দুর্বৃত্তরা দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যারা তাদের সাথে চোখ রাঙাতে দ্বিধাবোধ করছেনা। এটা চলমান থাকলে দেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবক্ষয়ের শক্ত প্রমান হিসেবে প্রতিফলিত হবে। কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব একটি গোষ্ঠী কিংবা দলের কাছে যেতে পারেনা। কথায় কথায় সচিবালয় ঘেরাও, আদালত ঘেরাও, বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও গুলো দৃষ্টিকটু এবং মুজিব আমলের রক্ষীবাহিনী কিংবা হাসিনা আমলের ছাত্রলীগেরই নামান্তর। এসব গুন্ডামি এখনো পর্যন্ত সহনীয় থাকলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে বন্ধ করতে হবে। এবং আইনকে তার নিজ গতিতে চলতে দিতে হবে। নাহলে হাসিনা আমলের থেকেও ভয়ঙ্কর অরাজকতার অপেক্ষা করছে দেশ। এবং আরব বসন্তের মতো এক স্বৈরাচার থেকে আরেক স্বৈরাচার এর হাতে ক্ষমতার পালাবদলের মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। 

ছবি: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান নোবেলজয়ী ইউনূস।


আবার ইউনূস সরকারের মেয়াদকাল নিয়েও আছে ধোয়াশা। যেহেতু সরকার নির্বাচনের আগাম কোন ইঙ্গিত দেয়নি সেক্ষেত্রে ছাত্রদের মাথায় ইউনূস সরকারের কাঠাল ভেঙে খাওয়ার প্রবণতাও উড়িয়ে দেয়া যায়না। এক্ষেত্রে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, অতিরিক্ত সময় পেলে ইউনূস সরকার সংবিধান নিজের অনূকূলে নিয়ে স্থায়ীভাবে ক্ষমতা দখল করতে পারে অথবা ১/১১ চালু করা তো একপ্রকার দুধভাতই বলা যায়, ইতোমধ্যেই ১/১১ এর দোসর দিয়ে সরকারের দল ভারীর কাজ চলছে। 


কিছুদিন বিএনপি যদিও নির্বাচনের রোডম্যাপ বাগিয়ে আনতে চেয়েছিলো কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের জন্য। 


এখন আসি নির্বাচনের পরের কথায়, ধরে নিলাম ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট খুবই সফল তারা সফলতার সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে ফেলেছে বিচার বিভাগ স্বাধীন ভাবে কাজ করছে সেক্ষেত্রে আমার আশঙ্কা হলো বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে ৩৬০° পল্টি মারে। (ধরেই নেয়া হচ্ছে পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। আওয়ামী লীগ পতনের পর বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী এখনও কেউ সেভাবে হয়ে উঠেনি। নতুন দল গঠন হলেও বিএনপি থেকে ফোকাসটা সরিয়ে নিতে ১০ বছরেরও বেশি সময় লাগবে নিশ্চিতভাবে।) সংসদে তখন হবে বিএনপির জয়জয়কার। স্বাধীন বিচার বিভাগকে হত্যা করার জন্য বিএনপি প্রচুর সময় পাবে।


পরিশেষে, নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন ও বাস্তবতার ফারাকটা অতি দীর্ঘ। ৩৬শে জুলাইয়ের স্বাধীনতার পর জনতার হৃদয়ে যে সুপ্ত বাসনার উদয় হয়েছিলো আজ একমাস পর বুঝতে পারছি আমরা সেই নতুন বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে। যার পুরোটা আজকের ব্লগে লিখতে গেলে লেখা পাঠক ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলবেন। সকল যদি এবং কিন্তুর পরেও নতুন বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। এটা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে এ সরকার চরম ব্যার্থ হিসেবে ধরে নেবো। নতুন বাংলাদেশের কফিনে এটা হবে শেষ পেরেক।

Comments

Popular posts from this blog

কাকের জায়গায় বক চাই না।

বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন এবং বাস্তবতা